রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

একটি খারাপ দিন-দ্বিতীয় পর্ব


অফিস ছুটির পর রিকশা নেয়ার চেষ্টা না করে এবার বাসে উঠি। প্রচন্ড ভিড়ে কে যেন জুতা দিয়ে আমার পা মাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠি, ‘আমার পা পিষ্ট করেছে কোন পাপিষ্ঠ রে। কথাটি বলেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিটির দিকে তাকাই। এমন মাগুর মাছের মতো কুত কুত কইরা চাইয়া থাইকেন না ভাই, গা শিরশির করে। বাসে উঠলে একটু আধটু লাগবোই, সহ্য না হলে নাইমা ট্যাক্সি ক্যাবে গিয়া উঠেন। এক নিঃশ্বাসে কথা কয়টি বলে দম নেন ভদ্রলোক।
ভাই, পকেটে ট্যাক্সি ক্যাবের ভাড়া থাকলে কি আর বাসে উঠে ছাগলের সঙ্গে ঝগড়া করি’ ! আমার নির্লিপ্ত বলার ভঙ্গিতে সারা বাসে হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। একটু পর কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চায়। কিন্তু প্যান্টের পেছনের হাত দিয়েই মাথায় যেন বাজ পড়ে আমার। হিপ পকেটে মানিব্যাগটা নেই। বাসে উঠার মুহূর্তেই কেউ...।
কী হইলো ভাইজান, ফ্রিজ হইয়া গেলেন ক্যান ! ভাড়াটা দেন। কন্ডাক্টরের তাগাদা শুনে আমি মিন মিন করে বলি, ‘ইয়ে- আমার মানি ব্যাগটা...
কি গায়েব হইয়া গেছে’ ? আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে কন্ডাক্টর। এই ধরনের কথা আমরা অন্তত ডেইলি দশবার শুনি, ধান্ধাবাজি ছাইড়া ভাড়া বাইর করেন। ওর কথা শুনে রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। ওই ব্যাটা, তোর পাঁচ টাকা ভাড়ার জন্যে আমি মিথ্যে কথা বলছি ? এক চড়ে চৌষট্টিটা দাঁত ফেলে দেব বদমাশ কোথাকার’! আমার মুখে কড়া ঝাড়ি খেয়ে এবার চুপসে যায় কন্ডাক্টর। কিন্তু পাশ থেকে একজন টিপ্পনী কেটে বলে, ‘ভাইজান, চৌষট্টি দাঁত পাইলেন কই ? রাগের মাথায় নিজের বত্রিশটা ও গোনায় ধরছেন নাকি’? আমি ঠান্ডা গলায় বলি, ‘আমি জানতাম আমাদের কথার মধ্যে তৃতীয় কোন গর্দভ নাক গলাবেই, তাই তার দাঁতও হিসেবে ধরে...

মালিবাগ মোড়ে বাস থেকে নেমে দেখি, কথিত এক ছিনতাইকারীকে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে পাবলিক। এই ছিনতাইকারী সম্প্রদায়ের ওপর আমার ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। বিয়ের পর কোন এক লোডশেডিংয়ের রাতে নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে নির্জন রাস্তায় একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছিলাম। এমন সময় অন্ধকারে যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয় তিন ছিনতাইকারী। নতুন বউয়ের গা থেকে ওরা জোর করে গয়না খুলে নিচ্ছিল। ওদের নিষ্ঠুর হাতের ছোঁয়ায় বউয়ের কান দুটি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। আহত কার আর গয়না হারানোর শোকে ডুকরে কেঁদে ওঠে বউ। ছিনতাইকারীদের এই অভদ্র নির্দয় আচরণে ওদের জন্মের বৈধতা নিয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই আমি সাহস করে প্রশ্ন করি, ‘হারামজাদারা, তোদের কি মা-বোন নেই’? আমার এই ধৃষ্টতায় ওরা যার পর নাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং নববধূর সামনে আমাকে দশ-দশবার কান ধরে ওঠ-বস করতে বাধ্য করে। সে দিনের সেই বেইজ্জতি হওয়ার ব্যথাটা এতোদিন পর চাগিয়ে ওঠে। অতঃপর জামার গুটিয়ে আমিও গণধোলাই তে অংশ নেই। হঠাৎ পুলিশের হুইসেল বেজে ওঠে। পুলিশ দেখে জনতার ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। ছিনতাইকারীর ত্রানকর্তাহিসেবে চিহ্নিত করে জনতা অতঃপর পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। ক্ষেপে গিয়ে পুলিশও পাল্টা অ্যাকশন নেয়। শুরু করে মৃদু লাঠিচার্জ। পুলিশের এই মৃদু লাঠিচার্জযে কতটুকু মৃদুতা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেই মৃদু লাঠিচার্জেরএকটি হঠাৎ করে এসে পড়ে আমার কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি আমি। সে অবস্থাতেই আমাকে জাপটে ধরে দু-তিনজন পুলিশ। অতঃপর চার হাত-পা ধরে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে মারে ভ্যানের ভেতর, যেন আমি রিলিফের মাল।

ছিনতাই করেন কবে থেকে’? থানার ডিউটি অফিসারের মুখে এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে আমার।
দেখুন আজে-বাজে প্রশ্ন করবেন না, আমি একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। আমার কণ্ঠে জোরালো প্রতিবাদ। ভিতরে ভিতরে অবশ্য অসম্ভব ঘাবড়ে যাই আমি। হায় আল্লাহ ! কেন যে ছিনতাইকারী পেটাতে গেলাম ! এখন পুলিশ কিনা আমাকেই ছিনতাইকারী বলে ফাঁসাতে চাচ্ছে ! রাগের মাথায় নিজের পাছাতেই কষে লাথি মারতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, দেখেতো অবশ্য ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। তবে এখন ভদ্রবেশেও অনেকে ছিনতাই করে। প্রথমে এসে বিনীতভাবে সালাম দেয়, কেমন আছেন-বলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। অতঃপর মামা, চাচা, খালু অথবা বড়ভাই সম্বোধনে আত্মীয়তার সম্পর্কও স্থাপন করে। তারপর পেটে ছুরি ঠেকিয়ে সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি করে হাসিমুখে বিদায় নেয়। সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে খুবই ভদ্রভাবে কাজ সারে এরা। যাওয়ার সময় গাড়িভাড়া বা রিকশা ভাড়াটা অন্তত ফেরত দিতে ভুল করে না। আমার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে থামেন অফিসার।
দেখুন স্যার, আমি মোটেও ছিনতাইকারী নই, আমি একজন চাকুরিজীবী। কণ্ঠ নামিয়ে বিড় বিড় করে বলি আমি। ইশ্ এমুহূর্তে পরিচয় পত্রটা যদি সঙ্গে থাকতো। কিন্তু ওটাতো মানিব্যাগের সঙ্গে এখন পকেট মারের পকেটে। উপায়ান্তর না দেখে বসের নাম আর ওনার বাসার টেলিফোন নম্বর উগরে দেই আমি।
আমার বসের নাম শুনেই একটু যেন থমকে যান ডিউটি অফিসার। তারপর ফোনের রিসিভার তুলে আমার দেয়া নম্বরে ডায়াল করেন। লাইন পেয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘স্যার, আমরা রাস্তা থেকে এক ছিনতাইকারী ধরেছি। সে বলছে, সে নাকি আপনার অফিসে চাকুরি করে, নিন স্যার কথা বলুন। আমার দিকে রিসিভার এগিয়ে দেন অফিসার।
স্যার, আমি ভুঁইয়া স্যার। নার্ভাস কণ্ঠে বলি আমি।
ভুঁইয়া ! কোন ভুঁইয়া ? বার ভুঁইয়ার কথা অবশ্য শুনেছি, কিন্তু তারাতো এখন ইতিহাসের পাতায়। বসের কণ্ঠে রসিকতার সুর।
আমি রহিম ভুঁইয়া, আপনার অফিস সহকারী স্যার
ও-ভুঁইয়া সাহেব ! আপনি থানায় কেন ! অফিস ছুটির পর এক্সট্রা ইনকামের ধান্ধা শুরু করলেন নাকি’? বসের ব্যাঙ্গাত্মক খোঁচা শুনে কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটা পড়ে আমার। না-মানে স্যার, আসলে হয়েছিল কি...। বিড় বিড় করে পুরো ঘটনাটির একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বস আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে ভুঁইয়া সাহেব, কাল অফিসেই না হয় আপনার অ্যাডভেঞ্চার বৃত্তান্তশুনবো, এখন অফিসার কে দিন
আম কল্পনার চোখে দেখতে পাই পরদিন সারা অফিস আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বিশেষ করে মিস পুদিনার উঁচু দাঁতের বিশ্রী হাসির কথা ভাবতে গিয়ে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার।

থানা থেকে বের হয়ে দ্রুত রিকশা নেই। গভীর রাতে গলির মুখে রিকশাঅলা আমাকে নামিয়ে দেয়। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সে গলিতে ঢুকতে সাহস করে না। এই গলিতে বাস করে এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। আমার জন্য সে রীতিমতো এক মূর্তমাণ বিভীষিকা। অথচ আমি কখনোই তাকে দেখে লাথি মারার জন্য পা তুলিনি কিংবা তার মুখ থেকে হাড্ডি কেড়ে নেইনি। তবুও অজ্ঞাত কারণে সে আমাকে দেখলেই তেড়ে আসে। এই মহল্লায় বাসা নেয়ার পর থেকেই এই নতুন শত্রু জুটেছে আমার। ওর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এক বন্ধুর পরামর্শে সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধন বিভাগেগিয়েছিলাম অভিযোগ করতে। এক ভদ্রলোক খাতা-কলম হাতে নিয়ে আমাকে রীতিমতো জেরা করার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা শুরু করেন। তার প্রশ্ন গুলো ছিল নিম্নরূপ।
নাম’?
রহীম উদ্দীন ভুঁইয়া
আপনার নাম না, কুত্তার নাম বলেন
বেওয়ারিশ কুকুরের আবার নাম কি’? আমি অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি।
আচ্ছা, ঠিকানা বলেন
ঠিকানাও নেই, রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়
যে রাস্তায় ঘুইরা বেড়ায়, তার লোকেশন বলেন
শান্তিবাগ ৩ নং গলি
কি জাতের কুকুর’?
কুত্তার আবার জাত কি’?
কি বলেন ! জাত আছে না ? ব্লাড হাউন্ড, অ্যালসেশিয়ান, বুলডগ, বুলটেরিয়র, ফক্সটেরিয়র, ডোবারম্যান, পিল্ক শার্ফ-এমন কতো জাতের কুকুর আছে দুনিয়ায়। আমাদের দেশী কুত্তা হইলেও জানা দরকার, সরাইলের না নড়াইলের ?
দেখুন, কুকুরের জাত নিয়ে গবেষণা করা আমার কর্ম নয়, সেটা ধরার পর আপনারাই জেনে নেবেন। চড়া গলায় কথাগুলো বলি আমি।
দেখুন মিস্টার, ধরার আগে আমাদেরকে তো কুকুরটাকে সনাক্ত করতে হবে, নাকি ? ঠিক আছে, গায়ের রঙ বলুন
শিয়ালু কালার। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলি আমি।
মানে’?
মানে বুঝলেন না ? শিয়ালের মতো গায়ের রঙ
মেল না ফিমেল’?
দেখেতো মরদা বলেই মনে হয়
উচ্চতা’?
এই ধরুন দেড় ফুট
দৈর্ঘ্য কতো’?
এবার সত্যি মেজাজটা চড়ে যায় আমার। ঠান্ডা গলায় বলি, ‘ভাইজান কি আমার সঙ্গে মশকরা করতেছেন’?
আপনি কি আমার বোনের হাজবেন্ড যে আপনার সঙ্গে মশকরা করবো ? সঠিক কুকুরটাকে সনাক্ত করার জন্যই আমাদের এই সব তথ্য জানা জরুরী
কিন্তু আমি কি গজ-ফিতা নিয়ে দৈর্ঘ্য মাপার জন্য একটি পাগলা কুকুরের সামনে যাবো, যে কুকুর আমাকে দেখলেই ধাওয়া করে
সেটা আপনার ব্যাপার। তবে শুধু দৈর্ঘ্য মেপে আনলেই চলবে না, লেজ সহ এবং লেজ ছাড়া-দুটি মাপই আনতে হবে। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো-বুঝতে পারি না। সরি, আমি সম্ভবত ভুল করে পাগলা গরাদে চলে এসেছি। কথা কয়টি বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসি আমি।

গলির মুখে রিকশা থেকে নামার পর আতঙ্কে পা চলেনা আমার। সন্ত্রাসীটা কোথায় ওঁৎ পেতে আছে কে জানে ! ভয়ে ভয়ে বাসার উদ্দেশে হাঁটতে থাকি আমি। কিন্তু কোথায় আছে যেখানে ডাকাতের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়েই যেন রাস্তার ওপর উদয় হয় ওটা। এক মুহূর্ত আমার চোখে স্থির চেয়ে থাকে। ওয়েস্টার্ন ছবিতে ড্রকরার আগে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যেভাবে একে অন্যকে যাচাই করে, অনেকটা সেরকম করে আমাকে জরিপ করে ওটা। তারপর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে কলিজা কাঁপানো ডাক ছেড়ে চিতা বাঘের মতো তেড়ে আসে আমার দিকে। আমিও পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করি। এক দৌড়ে বাড়ির কাছে এসে দেখি মেইন গেট বন্ধ। অতঃপর এক লাফে দেয়াল টপকে ওপাশে গিয়ে পড়ি। বেকায়দা ভঙ্গিতে শক্ত কংক্রিটের ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাই আমি।
হুঁশ ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মুখের ওপর বউয়ের অশ্রুসজল উদ্বিগ্ন মুখ। আমার বুকটা হু হু করে ওঠে। সত্যি আজ খুব বাজে একটা দিন গেছে আমার। হাতের আঙ্গুল দিয়ে বউয়ের চোখের অশ্রু মুছে দেই আমি।অফিস ছুটির পর রিকশা নেয়ার চেষ্টা না করে এবার বাসে উঠি। প্রচন্ড ভীড়ে কে যেন জুতা দিয়ে আমার পা মাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠি, ‘আমার পা পিষ্ট করেছে কোন পাপিষ্ঠ রে। কথাটি বলেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিটির দিকে তাকাই। এমন মাগুর মাছের মতো কুত কুত কইরা চাইয়া থাইকেন না ভাই, গা শিরশির করে। বাসে উঠলে একটু আধটু লাগবোই, সহ্য না হলে নাইমা ট্যাক্সি ক্যাবে গিয়া উঠেন। এক নি:শ্বাসে কথা কয়টি বলে দম নেন ভদ্রলোক।
ভাই, পকেটে ট্যাক্সি ক্যাবের ভাড়া থাকলে কি আর বাসে উঠে ছাগলের সঙ্গে ঝগড়া করি’ ! আমার নির্লিপ্ত বলার ভঙ্গিতে সারা বাসে হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। একটু পর কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চায়। কিন্তু প্যান্টের পেছনের হাত দিয়েই মাথায় যেন বাজ পড়ে আমার। হিপ পকেটে মানিব্যাগটা নেই। বাসে উঠার মুহূর্তেই কেউ...।
কী হইলো ভাইজান, ফ্রীজ হইয়া গেলেন ক্যান ! ভাড়াটা দেন। কন্ডাক্টরের তাগাদা শুনে আমি মিন মিন করে বলি, ‘ইয়ে- আমার মানি ব্যাগটা...
কি গায়েব হইয়া গেছে’ ? আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে কন্ডাক্টর। এই ধরনের কথা আমরা অন্তত ডেইলি দশবার শুনি, ধান্ধাবাজি ছাইড়া ভাড়া বাইর করেন। ওর কথা শুনে রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। ওই ব্যাটা, তোর পাঁচ টাকা ভাড়ার জন্যে আমি মিথ্যে কথা বলছি ? এক চড়ে চৌষট্টিটা দাঁত ফেলে দেব বদমাশ কোথাকার’! আমার মুখে কড়া ঝাড়ি খেয়ে এবার চুপসে যায় কন্ডাক্টর। কিন্তু পাশ থেকে একজন টিপ্পনী কেটে বলে, ‘ভাইজান, চৌষট্টি দাঁত পাইলেন কই ? রাগের মাথায় নিজের বত্রিশটাও গোনায় ধরছেন নাকি’? আমি ঠান্ডা গলায় বলি, ‘আমি জানতাম আমাদের কথার মধ্যে তৃতীয় কোন গর্দভ নাক গলাবেই, তাই তার দাঁতও হিসেবে ধরে...

মালিবাগ মোড়ে বাস থেকে নেমে দেখি, কথিত এক ছিনতাইকারীকে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে পাবলিক। এই ছিনতাইকারী সম্প্রদায়ের ওপর আমার ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। বিয়ের পর কোন এক লোডশেডিংয়ের রাতে নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে নির্জন রাস্তায় একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছিলাম। এমন সময় অন্ধকারে যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয় তিন ছিনতাইকারী। নতুন বউয়ের গা থেকে ওরা জোর করে গয়না খুলে নিচ্ছিল। ওদের নিষ্টুর হাতের ছোঁয়ায় বউয়ের কান দুটি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। আহত কার আর গয়না হারানোর শোকে ডুকরে কেঁদে ওঠে বউ। ছিনতাইকারীদের এই অভদ্র নির্দয় আচরণে ওদের জম্মের বৈধতা নিয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই আমি সাহস করে প্রশ্ন করি, ‘হারামজাদারা, তোদের কি মা-বোন নেই’? আমার এই ধৃষ্টতায় ওরা যার পর নাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং নববধূর সামনে আমাকে দশ-দশবার কান ধরে ওঠ-বস করতে বাধ্য করে। সে দিনের সেই বেইজ্জতি হওয়ার ব্যথাটা এতোদিন পর চাগিয়ে ওঠে। অতপর জামার গুটিয়ে আমিও গণধোলাই তে অংশ নেই। হঠাৎ পুলিশের হুইসেল বেজে ওঠে। পুলিশ দেখে জনতার ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। ছিনতাইকারীর ত্রানকর্তাহিসেবে চিহ্নিত করে জনতা অতপর পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। ক্ষেপে গিয়ে পুলিশও পাল্টা অ্যাকশন নেয়। শুরু করে মৃদু লাঠিচার্জ। পুলিশের এই মৃদু লাঠিচার্জযে কতটুকু মৃদুতা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেই মৃদু লাঠিচার্জেরএকটি হঠাৎ করে এসে পড়ে আমার কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি আমি। সে অবস্থাতেই আমাকে জাপটে ধরে দু-তিনজন পুলিশ। অতপর চার হাত-পা ধরে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে মারে ভ্যানের ভেতর, যেন আমি রিলিফের মাল।

ছিনতাই করেন কবে থেকে’? থানার ডিউটি অফিসারের মুখে এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে আমার।
দেখুন আজে-বাজে প্রশ্ন করবেন না, আমি একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। আমার কণ্ঠে জোরালো প্রতিবাদ। ভিতরে ভিতরে অবশ্য অসম্ভব ঘাবড়ে যাই আমি। হায় আল্লাহ ! কেন যে ছিনতাইকারী পেটাতে গেলাম ! এখন পুলিশ কিনা আমাকেই ছিনতাইকারী বলে ফাঁসাতে চাচ্ছে ! রাগের মাথায় নিজের পাছাতেই কষে লাথি মারতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, দেখেতো অবশ্য ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। তবে এখন ভদ্রবেশেও অনেকে ছিনতাই করে। প্রথমে এসে বিনীতভাবে সালাম দেয়, কেমন আছেন-বলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। অতপর মামা, চাচা, খালু অথবা বড়ভাই সম্বোধনে আত্মীয়তার সম্পর্কও স্থাপন করে। তারপর পেটে ছুরি ঠেকিয়ে সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে হ্যান্ড শ্যাক বা কোলাকুলি করে হাসিমুখে বিদায় নেয়। সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে খুবই ভদ্রভাবে কাজ সারে এরা। যাওয়ার সময় গাড়িভাড়া বা রিকশা ভাড়াটা অন্তত ফেরত দিতে ভুল করে না। আমার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে থামেন অফিসার।
দেখুন স্যার, আমি মোটেও ছিনতাইকারী নই, আমি একজন চাকুরিজীবী। কণ্ঠ নামিয়ে বিড় বিড় করে বলি আমি। ইশ্ এমুহূর্তে পরিচয় পত্রটা যদি সঙ্গে থাকতো। কিন্তু ওটাতো মানিব্যাগের সঙ্গে এখন পকেট মারের পকেটে। উপায়ান্তর না দেখে বসের নাম আর ওনার বাসার টেলিফোন নম্বর উগরে দেই আমি।
আমার বসের নাম শুনেই একটু যেন থমকে যান ডিউটি অফিসার। তারপর ফোনের রিসিভার তুলে আমার দেয়া নম্বরে ডায়াল করেন। লাইন পেয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘স্যার, আমরা রাস্তা থেকে এক ছিনতাইকারী ধরেছি। সে বলছে, সে নাকি আপনার অফিসে চাকুরি করে, নিন স্যার কথা বলুন। আমার দিকে রিসিভার এগিয়ে দেন অফিসার।
স্যার, আমি ভুঁইয়া স্যার। নার্ভাস কণ্ঠে বলি আমি।
ভুঁইয়া ! কোন ভুঁইয়া ? বার ভুঁইয়ার কথা অবশ্য শুনেছি, কিন্তু তারাতো এখন ইতিহাসের পাতায়। বসের কণ্ঠে রসিকতার সুর।
আমি রহিম ভুঁইয়া, আপনার অফিস সহকারী স্যার
ও-ভুঁইয়া সাহেব ! আপনি থানায় কেন ! অফিস ছুটির পর এক্সট্রা ইনকামের ধান্ধা শুরু করলেন নাকি’? বসের ব্যাঙ্গাত্মক খোঁচা শুনে কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটা পড়ে আমার। না-মানে স্যার, আসলে হয়েছিল কি...। বিড় বিড় করে পুরো ঘটনাটির একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বস আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে ভুঁইয়া সাহেব, কাল অফিসেই না হয় আপনার অ্যাডভেঞ্চার বৃত্তান্তশুনবো, এখন অফিসার কে দিন
আম কল্পনার চোখে দেখতে পাই পরদিন সারা অফিস আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বিশেষ করে মিস পুদিনার উঁচু দাঁতের বিশ্রী হাসির কথা ভাবতে গিয়ে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার।

থানা থেকে বের হয়ে দ্রুত রিকশা নেই। গভীর রাতে গলির মুখে রিকশাঅলা আমাকে নামিয়ে দেয়। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সে গলিতে ঢুকতে সাহস করে না। এই গলিতে বাস করে এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। আমার জন্য সে রীতিমতো এক মূর্তমাণ বিভীষিকা। অথচ আমি কখনোই তাকে দেখে লাথি মারার জন্য পা তুলিনি কিংবা তার মুখ থেকে হাড্ডি কেড়ে নেইনি। তবুও অজ্ঞাত কারনে সে আমাকে দেখলেই তেড়ে আসে। এই মহল্লায় বাসা নেয়ার পর থেকেই এই নতুন শত্রু জুটেছে আমার। ওর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এক বন্ধুর পরামর্শে সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধন বিভাগেগিয়েছিলাম অভিযোগ করতে। এক ভদ্রলোক খাতা-কলম হাতে নিয়ে আমাকে রীতিমতো জেরা করার ভঙ্গীতে প্রশ্ন করা শুরু করেন। তার প্রশ্ন গুলো ছিল নিম্নরূপ।
নাম’?
রহীম উদ্দীন ভুঁইয়া
আপনার নাম না, কুত্তার নাম বলেন
বেওয়ারিশ কুকুরের আবার নাম কি’? আমি অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি।
আচ্ছা, ঠিকানা বলেন
ঠিকানাও নেই, রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়
যে রাস্তায় ঘুইরা বেড়ায়, তার লোকেশন বলেন
শান্তিবাগ ৩ নং গলি
কি জাতের কুকুর’?
কুত্তার আবার জাত কি’?
কি বলেন ! জাত আছে না ? ব্লাড হাউন্ড, অ্যালসেশিয়ান, বুলডগ, বুলটেরিয়র, ফক্সটেরিয়র, ডোবারম্যান, পিল্ক শার্ফ-এমন কতো জাতের কুকুর আছে দুনিয়ায়। আমাদের দেশী কুত্তা হইলেও জানা দরকার, সরাইলের না নড়াইলের ?
দেখুন, কুকুরের জাত নিয়ে গবেষণা করা আমার কর্ম নয়, সেটা ধরার পর আপনারাই জেনে নেবেন। চড়া গলায় কথাগুলো বলি আমি।
দেখুন মিস্টার, ধরার আগে আমাদেরকে তো কুকুরটাকে সনাক্ত করতে হবে, নাকি ? ঠিক আছে, গায়ের রঙ বলুন
শিয়ালু কালার। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলি আমি।
মানে’?
মানে বুঝলেন না ? শিয়ালের মতো গায়ের রঙ
মেল না ফিমেল’?
দেখেতো মরদা বলেই মনে হয়
উচ্চতা’?
এই ধরুন দেড় ফুট
দৈর্ঘ্য কতো’?
এবার সত্যি মেজাজটা চড়ে যায় আমার। ঠান্ডা গলায় বলি, ‘ভাইজান কি আমার সঙ্গে মশকরা করতেছেন’?
আপনি কি আমার বোনের হাজবেন্ড যে আপনার সঙ্গে মশকরা করবো ? সঠিক কুকুরটাকে সনাক্ত করার জন্যই আমাদের এই সব তথ্য জানা জরুরী
কিন্তু আমি কি গজ-ফিতা নিয়ে দৈর্ঘ্য মাপার জন্য একটি পাগলা কুকুরের সামনে যাবো, যে কুকুর আমাকে দেখলেই ধাওয়া করে
সেটা আপনার ব্যাপার। তবে শুধু দৈর্ঘ্য মেপে আনলেই চলবে না, লেজ সহ এবং লেজ ছাড়া-দুটি মাপই আনতে হবে। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো-বুঝতে পারি না। সরি, আমি সম্ভবত ভুল করে পাগলা গরাদে চলে এসেছি। কথা কয়টি বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসি আমি।

গলির মুখে রিকশা থেকে নামার পর আতঙ্কে পা চলেনা আমার। সন্ত্রাসীটা কোথায় ওঁৎ পেতে আছে কে জানে ! ভয়ে ভয়ে বাসার উদ্দেশে হাঁটতে থাকি আমি। কিন্তু কোথায় আছে যেখানে ডাকাতের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়েই যেন রাস্তার ওপর উদয় হয় ওটা। এক মুহূর্ত আমার চোখে স্থির চেয়ে থাকে। ওয়েস্টার্ন ছবিতে ড্রকরার আগে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যেভাবে একে অন্যকে যাচাই করে, অনেকটা সেরকম করে আমাকে জরিপ করে ওটা। তারপর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে কলিজা কাঁপানো ডাক ছেড়ে চিতা বাঘের মতো তেড়ে আসে আমার দিকে। আমিও পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করি। এক দৌড়ে বাড়ির কাছে এসে দেখি মেইন গেট বন্ধ। অতঃপর এক লাফে দেয়াল টপকে ওপাশে গিয়ে পড়ি। বেকায়দা ভঙ্গিতে শক্ত কংক্রিটের ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাই আমি।
হুঁশ ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মুখের ওপর বউয়ের অশ্রুসজল উদ্বিগ্ন মুখ। আমার বুকটা হু হু করে ওঠে। সত্যি আজ খুব বাজে একটা দিন গেছে আমার। হাতের আঙ্গুল দিয়ে বউয়ের চোখের অশ্রু মুছে দেই আমি।

একটি খারাপ দিন



ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়, সকালে ঘুম থেকে উঠেই বউয়ের পা ধরতে হলো। শুধু পা ধরা হয়, রীতিমতো পায়ে তেলও মালিশ করতে হলো। বউয়ের আপন ছোটভাই, মানে আমার শ্যালক থাকে আবুধাবি। শালা সারাটা রাত ফোন যন্ত্রণা দিয়েছে। রিং হয়, ধরলেই লাইন কেটে যায়।
‘হ্যালো আমি মোতালেব......’। ব্যাস, এটুকু বলেই মোতালেব গায়েব। লাইনে শুধু ঘর ঘর শব্দ। টেলিফোনের এই তামাশা চলে মাঝ রাত পর্যন্ত। আমার শালা মোবাইল  ব্যবহার  করলেও পয়সা বাঁচানোর জন্য সাধারণত কোম্পানীর ফোন থেকেই আমার ল্যান্ডফোনে ফোন দেয়। শেষ রাতের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছে, এমন সময় কর্কশ শব্দে আবার রিং বেজে উঠে। বউ আমার শয্যা ছেড়ে পড়িমড়ি করে ছুটে ফোন ধরতে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অতঃপর গগনবিদারী আর্তচিৎকার, ‘ও মাগো ,মরে গেলাম....’। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বউকে মেঝে থেকে টেনে তুলি। তার কর্কশ কণ্ঠের অসহ্য চিৎকারে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। পা-টা বোধহয় একটু মচকে গেছে। তাড়াতাড়ি একটি চামচে তেল-রশুন গরম করে তার মচকানো পায়ে মালিশ করতে থাকি। বউ একটু ধাতস্থ হতেই তাকে বলি,
‘চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাক, একদম নড়াচড়া করবে না। আমি অফিসে যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো’।
অফিসে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরী হচ্ছি, এমন সময় কাজের মেয়েটি এসে বলে, ‘ভাইজান, নাস্তা এইখানে দিমু নাকি টেবিলে...?’ ‘ডাইনিং’য়েই দে’ আমি উত্তর দেই। মেয়েটি মুচকি হেসে চলে যায়। এই মেয়েটি কাজে-কর্মে খুবই ভালো, দোষ একটাই, কারণে-অকারণে শুধু দাঁত বের করে হাসে। দ্রুত নাস্তা সেরে চা খেতে খেতে ওর সঙ্গে কথা বলছি। ‘বুঝলি এলাচি, তোর চা কিন্তু চমৎকার হয়, তোর ভাবীর চাতো মুখেই দেয়া যায় না, অতি জঘন্য। তুই এতো সুন্দর চা বানাস কি করে, চায়ের সঙ্গে হাসি-টাসি মিশিয়ে দিস নাকি ?
আমার কথা শুনে এলাচি বেগম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, যেন ভারী মজার কথা বলেছি। হাসি জিনিসটা বড়ই সংক্রামক। ওর হাসি দেখে আমিও হাসতে শুরু করি। এমন সময় দরজায় উদয় হয় আমার রণরঙ্গিনী বউ। আমি বিস্মিত হই, মচকানো পা নিয়ে সে শয্যা ছেড়ে উঠে এলো কিভাবে ! ‘কী ব্যাপার, কাজের মেয়ের সঙ্গে বেশতো রঙ্গ-ঢঙ্গ করা হচ্ছে দেখছি, এদিকে যে অফিসের বেলা যায়। বউয়ের শীতল কণ্ঠের এই আপত্তিকর মন্তব্যে আমি বড্ড আহত হই। প্রতিবাদী কণ্ঠে বলি, ‘তোমার রঙ্গ-ঢঙ্গ শব্দটা খুবই অরুচিকর’। বউ এবার চটে উঠে বলে, ‘আমাকে রুচি শেখাতে এসো না, তোমার মতো মিচকে টাইপের পুরুষকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি’। সকাল বেলা বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার প্রবৃত্তি হয় না আমার। তাই কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।

গলির মুখে একটি খালি রিকশা দেখে লাফ দিয়ে চড়ে বসে বলি, ‘এ্যাই রিকশা মতিঝিল চল’। কিন্তু রিকশাঅলা এক চুলও নড়ে না, বরং এমন ভাব করে যেন শুনতেই পায়নি। আমি এবার ঝাঁঝের সঙ্গে বলি, ‘কিরে কানে বাতাস যায় না ? মতিঝিল চল’। রিকশাঅলা এবার ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আমি মতিঝিল যামু না, তুই আমার রিকশা থেইকা নাম’।
বলে কি হারামজাদা ! রিকশাওয়ালার ঔদ্ধত্য দেখে রীতিমতো বিস্মিত হই আমি। এতোবড় অপমান ! ভালো করে ব্যাটাকে জরিপ করি। আমার থেকে অন্তত বছর পাঁচেক বড় হবে লোকটি। কেতাদুরস্ত চেহারা। গায়ে ফুল ছাপা হাফ শার্ট, পরনে রঙচটা ফুল প্যান্ট। গলায় কায়দা করে একটা মাফলারও জড়িয়েছে। হাতে হাত ঘড়ি, দশাসই ফিগার, ডাকাতের মতো ভয়ংঙ্কর চোখ। ফুলপ্যান্ট পরে রিকশা চালায়, এমন রিকশাঅলা ঢাকা শহরে খুবই কম দেখা যায়। ওর ফিগার দেখে মনে মনে দমে যাই আমি। এই ‘মালের’ সঙ্গে লাগতে যাওয়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমার শ্রবণ শক্তি বিনষ্ট করা, কিংবা চাপার দাঁতগুলো স্থানচ্যুত করার জন্য কানের নিচে ওর সাঁড়াশি হাতের একটা লাগসই ঘুষিই যথেষ্ট। তাই ওর বেয়াদবিটা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নরম কন্ঠে বলি, ‘রাগ কর কেনরে ভাই ! তুমি না গেলে আমিতো আর জোর করে নিয়ে যেতে পারবো না। উঠেই যখন পড়েছি ভাড়া কতো নিবে সেটা বল’।
আমার ‘তুই’ সম্বোধন থেকে তুমিতে উত্তরণ রিকশাওয়ালাকে প্রভাবিত করে। সেও এবার গলার স্বর খাটো করে বলে, ‘আপনে আমার লগে তুই-তোকারি করলেন কেন ! রিকশা চালাই বইলা কি আমাগো মান-মর্যাদা নাই’ !

রিকশাওয়ালার কাছে এইভাবে চরম অপদস্ত হয়ে মেজাজটা খিঁচড়ে যায় আমার। অফিসে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে দেখি পিয়ন আবুল মিয়া সবাইকে মিষ্টি বিলাচ্ছে। এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার আফতাব সাহেব নাকি চতুর্থবারের মতো বাবা হয়েছেন, তাই খুশীতে মিষ্টি বিলানো হচ্ছে। আফতাব সাহেবের ভাগ্য দেখে বুকের গভীর থেকে একটি চোরা নি:শ্বাস ফেলি আমি। বিয়ের পন্চম বর্ষে উন্নীত হলেও আমার ভাগ্যে এখনো শিকে ছিঁড়লো না। মিষ্টি দেখে মনে মনে খুশী হয়ে উঠি আমি। রিকশাঅলার সঙ্গে ঝগড়া করে মুখটা তেতো হয়ে গেছে। কিন্তু সবাইকে মিষ্টি বিলিয়ে আবুল মিয়া যখন আমার টেবিলে আসে, তখন প্যাকেটে মাত্র একটি মিষ্টি অবশিষ্ট। আবুল মিয়া বিনীত কন্ঠে বলে, ‘স্যার মিষ্টিতো আছে মাত্র একটি, এইদিকে আমি এখনো খাই নাই। আসেন একটা মিষ্টিই দুইজনে ভাগাভাগি করে খাই’। কথাটি বলেই আবুল মিয়া মিষ্টিটি ভেঙ্গে দুই ভাগ করে। আমি গম্ভীর কন্ঠে বলি, ‘আবুল মিয়া, আমি মিষ্টি খাইনা, তুমি এখন যাও। আবুল মিয়া আমার কাছ ঘেঁষে অনুচ্চ কন্ঠে বলে, ‘স্যারের কি ডাইবেটিস হইছে’ ? আবুল মিয়ার আজাইরা প্রশ্নটি শুনে গা জ্বলে যায় আমার। গলা চড়িয়ে বলি, ‘আবুল মিয়া, আমি তোমাকে যেতে বলেছি’। আবুল মিয়া আর কথা না বাড়িয়ে এবার নি:শব্দে প্রস্থান করে। আমার মেজাজ এখন সপ্তমে। ভিতরে ভিতরে গরম লোহার মতো তেতে উঠতে থাকি আমি।
আবুল মিয়া একটু পর আবার এসে বলে, ‘বড় স্যারে আপনেরে সালাম দিছে’। অফিসে এসে বসতে না বসতেই বড় সাহেবের সালাম, ব্যাপারটা মোটেও শুভলক্ষণ নয়। বড় সাহেবের  রুমে ঢুকেই দেখে মিস পুদিনাকে। এই মহিলাকে দেখেই ভিতরে ভিতরে আমি ভীষণ টেনশনে পড়ে যাই। নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা হয়েছে। স্যার একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কি লিখেছেন এইসব ! দশ লাইনে বারোটা বানান ভুল। ‘মুহূর্ত’ বানান জানেন না, আপনারতো আবার স্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়া উচিত। আপনাকে চাকুরি দিয়েছে কে বলুনতো’ ?  চাকুরিদাতার নাম প্রকাশ করে সেই মহৎ ভদ্রলোকের আর মর্যাদাহানি করলাম না। যদিও সেই সহৃদয় ব্যাক্তি অফিস সহকারীর (মতান্তরে কেরানির) এই সাধারণ চাকুরির জন্য আমার কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছিল।
বসের সব জারিজুরি নীরবে হজম করে নিজের চেয়ারে এসে বসি। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কম্পিউটার অপারেটর মিস পুদিনার সামনে এভাবে বেইজ্জতি হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব এই আইবুড়ি মহিলার কাজ হলো কম্পিউটার কম্পোজ করা আর অবিবাহিত সব স্টাফদের সঙ্গে লটর-ফটর করা। ইদানীং সে অজ্ঞাত কারনে আমার পেছনে লেগেছে। মাথায় উকুন খোঁজার মতো করে সে আমার ড্রাফট থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভুল খুঁজে বের করে। তারপর আমাকে কিছু না বলে সরাসরি বসের কানে গিয়ে লাগায়। বস্ যখন আমাকে জারি দিচ্ছিল, পুদিনা বেগম তখন তা বিমলানন্দে উপভোগ করছিল আর বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসছিল। নাহ্ এই খাটাস মহিলাকে একটি উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। আচ্ছা এই স্বৈরাচারী বসের দূর্নীতির শ্বেতপত্র আর মিস পুদিনা বিষয়ক একটি রসালো গল্প তৈরী করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি উড়ো চিঠি দিলে কেমন হয় ! এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে অর্থাৎ একই সঙ্গে দুইজনকে সাইজ। আইডিয়াটি নিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকি আমি।
চলবে....।