রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

একটি খারাপ দিন



ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়, সকালে ঘুম থেকে উঠেই বউয়ের পা ধরতে হলো। শুধু পা ধরা হয়, রীতিমতো পায়ে তেলও মালিশ করতে হলো। বউয়ের আপন ছোটভাই, মানে আমার শ্যালক থাকে আবুধাবি। শালা সারাটা রাত ফোন যন্ত্রণা দিয়েছে। রিং হয়, ধরলেই লাইন কেটে যায়।
‘হ্যালো আমি মোতালেব......’। ব্যাস, এটুকু বলেই মোতালেব গায়েব। লাইনে শুধু ঘর ঘর শব্দ। টেলিফোনের এই তামাশা চলে মাঝ রাত পর্যন্ত। আমার শালা মোবাইল  ব্যবহার  করলেও পয়সা বাঁচানোর জন্য সাধারণত কোম্পানীর ফোন থেকেই আমার ল্যান্ডফোনে ফোন দেয়। শেষ রাতের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছে, এমন সময় কর্কশ শব্দে আবার রিং বেজে উঠে। বউ আমার শয্যা ছেড়ে পড়িমড়ি করে ছুটে ফোন ধরতে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অতঃপর গগনবিদারী আর্তচিৎকার, ‘ও মাগো ,মরে গেলাম....’। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বউকে মেঝে থেকে টেনে তুলি। তার কর্কশ কণ্ঠের অসহ্য চিৎকারে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। পা-টা বোধহয় একটু মচকে গেছে। তাড়াতাড়ি একটি চামচে তেল-রশুন গরম করে তার মচকানো পায়ে মালিশ করতে থাকি। বউ একটু ধাতস্থ হতেই তাকে বলি,
‘চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাক, একদম নড়াচড়া করবে না। আমি অফিসে যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো’।
অফিসে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরী হচ্ছি, এমন সময় কাজের মেয়েটি এসে বলে, ‘ভাইজান, নাস্তা এইখানে দিমু নাকি টেবিলে...?’ ‘ডাইনিং’য়েই দে’ আমি উত্তর দেই। মেয়েটি মুচকি হেসে চলে যায়। এই মেয়েটি কাজে-কর্মে খুবই ভালো, দোষ একটাই, কারণে-অকারণে শুধু দাঁত বের করে হাসে। দ্রুত নাস্তা সেরে চা খেতে খেতে ওর সঙ্গে কথা বলছি। ‘বুঝলি এলাচি, তোর চা কিন্তু চমৎকার হয়, তোর ভাবীর চাতো মুখেই দেয়া যায় না, অতি জঘন্য। তুই এতো সুন্দর চা বানাস কি করে, চায়ের সঙ্গে হাসি-টাসি মিশিয়ে দিস নাকি ?
আমার কথা শুনে এলাচি বেগম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, যেন ভারী মজার কথা বলেছি। হাসি জিনিসটা বড়ই সংক্রামক। ওর হাসি দেখে আমিও হাসতে শুরু করি। এমন সময় দরজায় উদয় হয় আমার রণরঙ্গিনী বউ। আমি বিস্মিত হই, মচকানো পা নিয়ে সে শয্যা ছেড়ে উঠে এলো কিভাবে ! ‘কী ব্যাপার, কাজের মেয়ের সঙ্গে বেশতো রঙ্গ-ঢঙ্গ করা হচ্ছে দেখছি, এদিকে যে অফিসের বেলা যায়। বউয়ের শীতল কণ্ঠের এই আপত্তিকর মন্তব্যে আমি বড্ড আহত হই। প্রতিবাদী কণ্ঠে বলি, ‘তোমার রঙ্গ-ঢঙ্গ শব্দটা খুবই অরুচিকর’। বউ এবার চটে উঠে বলে, ‘আমাকে রুচি শেখাতে এসো না, তোমার মতো মিচকে টাইপের পুরুষকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি’। সকাল বেলা বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার প্রবৃত্তি হয় না আমার। তাই কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।

গলির মুখে একটি খালি রিকশা দেখে লাফ দিয়ে চড়ে বসে বলি, ‘এ্যাই রিকশা মতিঝিল চল’। কিন্তু রিকশাঅলা এক চুলও নড়ে না, বরং এমন ভাব করে যেন শুনতেই পায়নি। আমি এবার ঝাঁঝের সঙ্গে বলি, ‘কিরে কানে বাতাস যায় না ? মতিঝিল চল’। রিকশাঅলা এবার ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আমি মতিঝিল যামু না, তুই আমার রিকশা থেইকা নাম’।
বলে কি হারামজাদা ! রিকশাওয়ালার ঔদ্ধত্য দেখে রীতিমতো বিস্মিত হই আমি। এতোবড় অপমান ! ভালো করে ব্যাটাকে জরিপ করি। আমার থেকে অন্তত বছর পাঁচেক বড় হবে লোকটি। কেতাদুরস্ত চেহারা। গায়ে ফুল ছাপা হাফ শার্ট, পরনে রঙচটা ফুল প্যান্ট। গলায় কায়দা করে একটা মাফলারও জড়িয়েছে। হাতে হাত ঘড়ি, দশাসই ফিগার, ডাকাতের মতো ভয়ংঙ্কর চোখ। ফুলপ্যান্ট পরে রিকশা চালায়, এমন রিকশাঅলা ঢাকা শহরে খুবই কম দেখা যায়। ওর ফিগার দেখে মনে মনে দমে যাই আমি। এই ‘মালের’ সঙ্গে লাগতে যাওয়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমার শ্রবণ শক্তি বিনষ্ট করা, কিংবা চাপার দাঁতগুলো স্থানচ্যুত করার জন্য কানের নিচে ওর সাঁড়াশি হাতের একটা লাগসই ঘুষিই যথেষ্ট। তাই ওর বেয়াদবিটা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নরম কন্ঠে বলি, ‘রাগ কর কেনরে ভাই ! তুমি না গেলে আমিতো আর জোর করে নিয়ে যেতে পারবো না। উঠেই যখন পড়েছি ভাড়া কতো নিবে সেটা বল’।
আমার ‘তুই’ সম্বোধন থেকে তুমিতে উত্তরণ রিকশাওয়ালাকে প্রভাবিত করে। সেও এবার গলার স্বর খাটো করে বলে, ‘আপনে আমার লগে তুই-তোকারি করলেন কেন ! রিকশা চালাই বইলা কি আমাগো মান-মর্যাদা নাই’ !

রিকশাওয়ালার কাছে এইভাবে চরম অপদস্ত হয়ে মেজাজটা খিঁচড়ে যায় আমার। অফিসে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে দেখি পিয়ন আবুল মিয়া সবাইকে মিষ্টি বিলাচ্ছে। এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার আফতাব সাহেব নাকি চতুর্থবারের মতো বাবা হয়েছেন, তাই খুশীতে মিষ্টি বিলানো হচ্ছে। আফতাব সাহেবের ভাগ্য দেখে বুকের গভীর থেকে একটি চোরা নি:শ্বাস ফেলি আমি। বিয়ের পন্চম বর্ষে উন্নীত হলেও আমার ভাগ্যে এখনো শিকে ছিঁড়লো না। মিষ্টি দেখে মনে মনে খুশী হয়ে উঠি আমি। রিকশাঅলার সঙ্গে ঝগড়া করে মুখটা তেতো হয়ে গেছে। কিন্তু সবাইকে মিষ্টি বিলিয়ে আবুল মিয়া যখন আমার টেবিলে আসে, তখন প্যাকেটে মাত্র একটি মিষ্টি অবশিষ্ট। আবুল মিয়া বিনীত কন্ঠে বলে, ‘স্যার মিষ্টিতো আছে মাত্র একটি, এইদিকে আমি এখনো খাই নাই। আসেন একটা মিষ্টিই দুইজনে ভাগাভাগি করে খাই’। কথাটি বলেই আবুল মিয়া মিষ্টিটি ভেঙ্গে দুই ভাগ করে। আমি গম্ভীর কন্ঠে বলি, ‘আবুল মিয়া, আমি মিষ্টি খাইনা, তুমি এখন যাও। আবুল মিয়া আমার কাছ ঘেঁষে অনুচ্চ কন্ঠে বলে, ‘স্যারের কি ডাইবেটিস হইছে’ ? আবুল মিয়ার আজাইরা প্রশ্নটি শুনে গা জ্বলে যায় আমার। গলা চড়িয়ে বলি, ‘আবুল মিয়া, আমি তোমাকে যেতে বলেছি’। আবুল মিয়া আর কথা না বাড়িয়ে এবার নি:শব্দে প্রস্থান করে। আমার মেজাজ এখন সপ্তমে। ভিতরে ভিতরে গরম লোহার মতো তেতে উঠতে থাকি আমি।
আবুল মিয়া একটু পর আবার এসে বলে, ‘বড় স্যারে আপনেরে সালাম দিছে’। অফিসে এসে বসতে না বসতেই বড় সাহেবের সালাম, ব্যাপারটা মোটেও শুভলক্ষণ নয়। বড় সাহেবের  রুমে ঢুকেই দেখে মিস পুদিনাকে। এই মহিলাকে দেখেই ভিতরে ভিতরে আমি ভীষণ টেনশনে পড়ে যাই। নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা হয়েছে। স্যার একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কি লিখেছেন এইসব ! দশ লাইনে বারোটা বানান ভুল। ‘মুহূর্ত’ বানান জানেন না, আপনারতো আবার স্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়া উচিত। আপনাকে চাকুরি দিয়েছে কে বলুনতো’ ?  চাকুরিদাতার নাম প্রকাশ করে সেই মহৎ ভদ্রলোকের আর মর্যাদাহানি করলাম না। যদিও সেই সহৃদয় ব্যাক্তি অফিস সহকারীর (মতান্তরে কেরানির) এই সাধারণ চাকুরির জন্য আমার কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছিল।
বসের সব জারিজুরি নীরবে হজম করে নিজের চেয়ারে এসে বসি। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কম্পিউটার অপারেটর মিস পুদিনার সামনে এভাবে বেইজ্জতি হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব এই আইবুড়ি মহিলার কাজ হলো কম্পিউটার কম্পোজ করা আর অবিবাহিত সব স্টাফদের সঙ্গে লটর-ফটর করা। ইদানীং সে অজ্ঞাত কারনে আমার পেছনে লেগেছে। মাথায় উকুন খোঁজার মতো করে সে আমার ড্রাফট থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভুল খুঁজে বের করে। তারপর আমাকে কিছু না বলে সরাসরি বসের কানে গিয়ে লাগায়। বস্ যখন আমাকে জারি দিচ্ছিল, পুদিনা বেগম তখন তা বিমলানন্দে উপভোগ করছিল আর বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসছিল। নাহ্ এই খাটাস মহিলাকে একটি উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। আচ্ছা এই স্বৈরাচারী বসের দূর্নীতির শ্বেতপত্র আর মিস পুদিনা বিষয়ক একটি রসালো গল্প তৈরী করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি উড়ো চিঠি দিলে কেমন হয় ! এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে অর্থাৎ একই সঙ্গে দুইজনকে সাইজ। আইডিয়াটি নিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকি আমি।
চলবে....।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন